বিজ্ঞাপন কি, বিজ্ঞাপনের বৈশিষ্ট্য, উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “বাউবি ও এসবিবিএ ৩৫০৫ বিপণন প্রসার” এর “বিজ্ঞাপন-বিপণন প্রসারের মূল হাতিয়ার” ইউনিট ২ এর অন্তর্ভুক্ত।
বিজ্ঞাপন কি, বিজ্ঞাপনের বৈশিষ্ট্য, উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব
বিপণন প্রসারের সর্বাধিক ব্যবহৃত এবং জনপ্রিয় হাতিয়ার হচ্ছে বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন হলো একটি প্রতিষ্ঠান বা তার পণ্য, সেবা ও ধারণা সম্পর্কে অর্থ প্রদত্ত কোন মাধ্যমে নির্দিষ্ট ক্রেতা বা ভোক্তার উদ্দেশ্য নৈর্ব্যক্তিক উপস্থাপনা। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে একটি কোম্পানি তার পণ্য বা সেবা সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত করে এবং পণ্য বা সেবা কিনতে তাদের প্ররোচিত করে। বর্তমান যুগকে বিজ্ঞাপনের যুগ বলা যায়। ছোট-বড় সকল কোম্পানিই বর্তমান সময়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে কোন না কোন ধরণের বিজ্ঞাপন ব্যবহার করেই। ভোক্তাসাধারণ বিজ্ঞাপন সম্পর্কে সচেতন হোক বা না হোক, বাজারে বিজ্ঞাপন সর্বদাই উপস্থিত থাকে।
আজকের প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে বিজ্ঞাপনদাতারা অভীষ্ট ভোক্তাদের কাছে তাদের পণ্য বার্তা পৌঁছানোর জন্য সম্ভাব্য প্রতিটি মাধ্যম ব্যবহার করে থাকেন। বিজ্ঞাপনের মাধ্যম হিসেবে টেলিভিশন, প্রিন্ট মাধ্যম যেমন- সংবাদপত্র, সাময়িকী, জার্নাল ইত্যাদি, রেডিও, ইন্টারনেট, সরাসরি বিক্রয়, হোর্ডিং, মেইলার, উদ্যোক্তা প্রতিযোগিতা, এমনকি নানারকম সেলিব্রেটিদেরও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য হল বিজ্ঞাপনদাতার পণ্য বা সেবার বিক্রয় বাড়ানোর জন্য ভোক্তাদের জানানো বা তাদের ক্রয় সিদ্ধান্তকে উদ্বুদ্ধ ও প্রভাবিত করা।
বিজ্ঞাপন বলতে কী বুঝায় ? (What is meant by Advertising?)
বিজ্ঞাপন হলো পণ্য এবং সেবার প্রসারের জন্য সর্বাধিক ব্যবহৃত একটি শক্তিশালী বিপণন হাতিয়ার যা একটি কোম্পানিকে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে, তাদের পণ্য সম্পর্কে অবহিত করতে এবং গ্রাহকের আস্থা তৈরি করতে সাহায্য করে। বেশিরভাগ কোম্পানি তাদের পণ্য বা সেবার প্রসারের জন্য কোন না কোন ধরণের বিজ্ঞাপন ব্যবহার করে থাকে। বিজ্ঞাপন হল নির্দিষ্ট উদ্যোক্তা কর্তৃক প্রদত্ত কোন পণ্য, সেবা বা ধারণার অর্থপ্রদত্ত কিন্তু অব্যক্তিক প্রসার যা বর্তমান ও সম্ভাব্য ক্রেতাদের প্রভাবিত করার জন্য প্রদান করা হয়। এটি সরকারি, বেসরকারি ও দাতব্য সংস্থা সহ সব ধরণের সংস্থা কর্তৃক ব্যবহৃত হয়। প্রতিষ্ঠানের অফার সম্পর্কিত তথ্য সহজেই বিস্তৃত ভোক্তাসাধারণের সাথে যোগাযোগ করার জন্য বিজ্ঞাপন হল একটি ভালো উপায়।
স্যাটেলাইট টেলিভিশন, ক্যাবল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট, প্রিন্ট মিডিয়া বা হালের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদি গণমাধ্যমের জনপ্রিয়তার সাথে সাথে বিজ্ঞাপনের পরিধি ও গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই কোম্পানিগুলো তাদের পণ্য বা সেবার বিজ্ঞাপনের জন্য বিশাল বাজেট বরাদ্ধ দিচ্ছে। একটি কোম্পানি যখন কোন বাজারে ব্যবসা শুরু করতে চায় এবং তার পণ্য বা সেবার জন্য শক্ত একটি অবস্থান নিশ্চিত করতে চায়, তখন তার জন্য অবশ্যই বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন। আজকাল বিজ্ঞাপন দেয় না এমন কোন প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যাবে না। সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও, সাময়িকী, পোস্টার, হোর্ডিং, বিলবোর্ড এবং সাম্প্রতিক সময়ে ইন্টারনেটের মতো বিভিন্ন মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেওয়া যেতে পারে।
বিজ্ঞাপনের মূল লক্ষ্যই হলো সম্ভাব্য ক্রেতাদের পণ্য বা সেবা সম্পর্কে অবহিত করা এবং প্ররোচিত করা। নিম্নে বিজ্ঞাপনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো :
Kotler and Armstrong-4, “Advertising is any paid form of nonpersonal presentation and promotion of ideas, goods, or services by an identified sponsor.” (অর্থাৎ, নির্দিষ্ট উদ্যোক্তা কর্তৃক অর্থ প্রদত্ত উপায়ে পণ্য, সেবা বা ধারণার নৈর্ব্যক্তিক বা অব্যক্তিক উপস্থাপনাকে বিজ্ঞাপন বলে।)
Belch and Belch -, “Advertising is any paid form of nonpersonal communication about an organization, product, service, or idea by an identified sponsor.” (অর্থাৎ, নির্দিষ্ট উদ্যোক্তা কর্তৃক একটি প্রতিষ্ঠান, পণ্য, সেবা বা ধারণা সম্পর্কে অর্থ প্রদত্ত উপায়ে নৈর্ব্যক্তিক যোগাযোগকে বিজ্ঞাপন বলে।)
Skinner and Ivancevich-4, “Advertising is a paid form of nonpersonal communication about an organization, its products or its activities that is transmitted through a mass medium to a target audience.” (অর্থাৎ, কোন প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠানের পণ্য বা প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলি সম্পর্কিত তথ্য গণমাধ্যমের সাহায্যে অর্থের বিনিময়ে নৈর্ব্যক্তিক উপায়ে অভীষ্ট অডিয়্যান্সদের কাছে প্রেরণ করাকে বিজ্ঞাপন বলে।)
Stanton, Etzel and Walker -, “Advertising consists of all the activities involved in presenting to an audience, a nonpersonal, sponsor identified, paid-for sponsored message about a produt or organization.” (অর্থাৎ, একটি পণ্য বা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নির্দিষ্ট উদ্যোক্তা কর্তৃক অর্থ প্রদত্ত উপায়ে অডিয়্যান্স বা শ্রোতাদের কাছে বার্তা উপস্থাপনের সাথে জড়িত সমস্ত কার্যকলাপকেই বিজ্ঞাপন বলা হয়।)
উপরের আলোচনা ও সংজ্ঞা সমূহ বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে বলা যায়-
- বিজ্ঞাপন অর্থ প্রদত্ত উপায়ে হয়;
- সুনির্দিষ্ট উদ্যোক্তা কর্তৃক প্রদত্ত হয়;
- পণ্য, সেবা বা ধারণার অব্যক্তিক উপস্থাপনার মাধ্যমে হয়;
- এটি একটি একমূখী যোগাযোগ ব্যবস্থা ;
- বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে বার্তা প্রদান করা হয়।
পরিশেষে বলা যায়, কোম্পানির পণ্য, সেবা বা ধারণার চাহিদা সৃষ্টি, বৃদ্ধি ও অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে নির্দিষ্ট উদ্যোক্তা কর্তৃক অর্থের বিনিময়ে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় তথ্যের নৈর্ব্যক্তিক উপস্থাপনাকেই বিজ্ঞাপন বলে ।
বিজ্ঞাপনের বৈশিষ্ট্য ( Characteristics/Features of Advertising):
বিজ্ঞাপন হলো পণ্য বা সেবার প্রচারের জন্য অর্থ প্রদানের মাধ্যমে নৈর্ব্যক্তিক যোগাযোগের একটি মাধ্যম। এটি সম্ভাব্য সর্বনিম্ন খরচে অভীষ্ট গ্রাহকদের কাছে সবচেয়ে প্ররোচক বিক্রয় বার্তা প্রদানের অন্যতম কার্যকর একটি মাধ্যম। তাই এটি বিপণন প্রসারের সর্বাধিক ব্যবহৃত হাতিয়ার গুলির মধ্যে একটি। বিজ্ঞাপনের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য গুলো হচ্ছে-
১. অর্থ প্রদত্ত মাধ্যম (Paid form):
বিজ্ঞাপনী সংস্থার দ্বারা পরিচালিত যোগাযোগের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ খরচ হয় যা উদ্যোক্তা প্রদান করে থাকেন। বাজারে নানা রকমের বিজ্ঞাপনী সংস্থা রয়েছে যারা ব্যবসায় প্রচারমূলক বিভিন্ন সেবা প্রদান করে এবং তাদের সেবার জন্য বিভিন্ন রকমের ফি আদায় করে। যাহোক, কোম্পানিগুলো কেবল কার্যকর ফলাফল পাওয়ার জন্য যে অর্থ প্রদান করে তার চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তৈরি করে ।
২. নৈর্ব্যক্তিকতা (Impersonality):
বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে লক্ষ্যস্থিত গ্রাহক এবং বিজ্ঞাপনদাতার মধ্যে কোন মুখোমুখি যোগাযোগ হয় না, যা বিজ্ঞাপনের নৈর্ব্যক্তিক প্রকৃতির দিকে ইঙ্গিত করে। যেহেতু এটি একটি একতরফা যোগাযোগ, বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে তাই একটি মনোযোগ তৈরি হয়, সংলাপ নয়। অন্যভাবে বলা যায়, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিজ্ঞাপনদাতা এবং ভোক্তার মধ্যে ব্যক্তিগত যোগাযোগ হয় না ।
৩. নির্দিষ্ট উদ্যোক্তা (Identified sponsor) :
বিজ্ঞাপনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এর উদ্যোক্তাকে বা বিজ্ঞাপনদাতাকে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। যখনই আমরা একটি বিজ্ঞাপনের মুখোমুখি হই, সাধারণত তখনই আমরা এর বিজ্ঞাপনদাতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে চিনতে পারি। তাই যদি কোন কারণে স্পন্সর বা উদ্যোক্তাকে শনাক্ত করা কঠিন হয়, তাহলে সেই তথ্যকে বিজ্ঞাপন বলা যাবে না ।
৪. বিস্তৃত অভিব্যক্তি (Amplified expressiveness):
বিজ্ঞাপন যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে কারণ এটি সর্বশেষ প্রযুক্তি, গ্রাফিক্স এবং মিডিয়া ব্যবহার করে। আধুনিক বিজ্ঞাপন পণ্যগুলোকে আরও আকর্ষণীয়, আকাঙ্ক্ষিত এবং অভিব্যক্তিপূর্ণ করে তোলে।
৫. গণ বিস্তৃতি (Mass reach):
বিজ্ঞাপনের ব্যাপক বিস্তৃতি বা নাগাল রয়েছে কারণ এটি একসাথে বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে পৌছাতে পারে। উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে টিকা নেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়ে সরকারের দেওয়া বিজ্ঞাপন সংবাদপত্র, টেলিভিশন বা রেডিওতে প্রদত্ত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছেছে।
৬. মনোযোগ অন্বেষণকারী (Attention seeker):
‘বিজ্ঞাপন’ শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘ advertere’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে যার অর্থ ‘to turn the attention’ বা ‘মনোযোগ ফেরানো’। বিজ্ঞাপনের প্রতিটি অংশই একেকটি বার্তা প্রদানের মাধ্যমে একটি পণ্য বা সেবার প্রতি ভোক্তা বা শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে ।
৭. অনন্য বিক্রয় প্রস্তাব (Unique selling proposition):
প্রত্যেক বিজ্ঞাপনদাতারই একটি অনন্য বিক্রয় প্রস্তাব (ইউএসপি) থাকতে হয়। এই অনন্য বিক্রয় প্রস্তাব বিক্রেতার পণ্য বা সেবাকে প্রতিযোগী পণ্য থেকে আলাদাভাবে চিনতে সাহায্য করে। বিজ্ঞাপনদাতা তার অনন্য বিক্রয় প্রস্তাব এবং বিভিন্ন ধরণের আবেদনের মাধ্যমে দর্শকদের বোঝানোর এবং পণ্য ক্রয়ে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে থাকেন।
৮. লক্ষ্য কেন্দ্রিকতা (Target oriented):
বিজ্ঞাপনগুলো তৈরি করা হয় অভীষ্ট গ্রাহক এবং বাজারের চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে এবং চাহিদা পূরণ করার প্রস্তাবনা নিয়ে। বিজ্ঞাপনগুলো প্রাসঙ্গিক অক্ষর, থিম, স্লোগান বা বাছাই করা স্টোরিলাইন ইত্যাদি দিয়ে অভীষ্ট গ্রাহক এবং বাজারকে চিত্রিত করে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, হরলিক্স, কমপ্ল্যান বা বুস্ট ইত্যাদির মতো প্রোটিন হেলথ ড্রিংকস গুলোর বিজ্ঞাপন শহুরে তরুণদের প্রতিনিধিত্বকারী শিশুদের দিকে লক্ষ্য করে তৈরি করা হয় এবং বিজ্ঞাপনের আবেগগুলো পড়াশোনা, খেলাধুলা এবং প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হওয়ার দিকে লক্ষ্য রেখে উপস্থাপন করা হয় ।
৯. দৃশ্যত আকর্ষণীয় (Visually attractive ) :
দৃশ্যমান এবং অ-মৌখিক উপাদানগুলো বিজ্ঞাপনে একটি প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে। একটি চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপন সতেজ তথ্য ব্যবহার করে এবং কাঙ্ক্ষিত বার্তাটি বোঝাতে দৃশ্যমান ব্যবহারের উপর ফোকাস করে। বিজ্ঞাপনগুলোতে ব্যবহৃত ভিজ্যুয়াল বা দৃশ্যমান উপাদানগুলো কেবল পণ্য তথ্যই প্রকাশ করে না, বরং একটি গল্পও বলে। তাই বিজ্ঞাপনে সৃজনশীলতার মাধ্যমে একটি শৈল্পিক, আকর্ষণীয় এবং গ্রহণযোগ্য উপায়ে একটি পণ্য উপস্থাপন করা হয়।
১০. বিভন্ন মিডিয়া ব্যবহার করে (Uses various media):
সংবাদপত্র এবং সাময়িকীর মতো মুদ্রণ প্ল্যাটফর্মগুলো ছাড়াও বিজ্ঞাপনের উপস্থিতি এখন নানাবিধ অনলাইন ও অডিওভিজ্যুয়াল প্ল্যাটফর্ম যেমন- ফিল্ম, হোর্ডিং, ব্যানার, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং এই জাতীয় অনেক প্রচার প্রচারণায় দেখা যায়। বিজ্ঞাপন সম্ভাব্য সকল মাধ্যম ব্যবহার করে ভোক্তাদের জ্ঞানকে প্রসারিত করে। ফলে ভোক্তারা হাতের কাছে থাকা নানা মাধ্যম থেকে বাজারে বিদ্যমান পণ্য, ব্র্যান্ড বা সেবাগুলো সম্পর্কে জানতে পারে।
এসব বৈশিষ্ট্যই বিজ্ঞাপনকে প্রচলিত অন্যান্য প্রসার হাতিয়ারের থেকে আলাদা এবং জনপ্রিয় করেছে।
বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য (Objectives of Advertising):
বিজ্ঞাপন হলো একজন চিহ্নিত উদ্যোক্তা কর্তৃক অব্যক্তিক যোগাযোগের একটি অর্থ প্রদত্ত মাধ্যম যা কোম্পানি, পণ্য, সেবা, ধারণা বা বিজ্ঞাপন দাতার প্রতি ক্রেতাসাধারণের মনোযোগ আকর্ষণ করে। সহজভাবে বলা যায়, বিজ্ঞাপন হচ্ছে অর্থপ্রদত্ত অব্যক্তিক যোগাযোগের এমন একটি প্রক্রিয়া যা জনসাধারণকে কোনকিছু সম্পর্কে অবহিত করার উদ্দেশ্যে বা কোনকিছু ক্রয় করার বা কোন নির্দিষ্ট কাজ করার জন্য তাদের প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। বিজ্ঞাপনের ৩ টি প্রধান উদ্দেশ্য রয়েছে- ব্র্যান্ড বা অফার সম্পর্কে অবহিত করা, কোন কাজ সম্পাদন করতে বা কোন কিছু ক্রয় করতে প্ররোচিত করা এবং ব্র্যান্ডের বা অফারের বার্তাটি পুনঃপুনঃ মনে করিয়ে দেওয়া। নিম্নের চিত্রের সাহায্যে বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্যগুলোকে সংক্ষেপে উপস্থাপন করা যায়:
১. অবহিত করা (To inform):
বিজ্ঞাপনগুলো সম্ভাব্য গ্রাহকদের ব্র্যান্ড বা পণ্য সম্পর্কে অবহিত করে অভীষ্ট বাজারে ব্র্যান্ড সচেতনতা এবং ব্র্যান্ড পরিচিতি বাড়াতে সাহায্য করে। তথ্যপূর্ণ বিজ্ঞাপন ব্র্যান্ড, পণ্য, সেবা এবং ধারণা সম্পর্কে ভোক্তাসাধারণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করে। তাছাড়া এটি নতুন পণ্য এবং কর্মসূচী ঘোষণা করতে এবং নতুন বা প্রতিষ্ঠিত পণ্যের বৈশিষ্ট্য এবং সুবিধাদি সম্পর্কে ভোক্তা সাধারণকে শিক্ষিত করতে পারে।
২. প্ররোচিত করা (To persuade):
একটি নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদনের জন্য গ্রাহকদের প্ররোচিত করাও বিজ্ঞাপনের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য। কাজগুলোর মধ্যে প্রদত্ত পণ্য এবং সেবাগুলো কেনা বা ব্যবহারের চেষ্টা করা, একটি ব্র্যান্ডের চিত্র তৈরি করা, ব্র্যান্ডের প্রতি অনুকূল মনোভাব তৈরি করা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। প্ররোচক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোম্পানি গ্রাহকদের বোঝানোর চেষ্টা করে যে তাদের পণ্য বা সেবা গুলোই সর্বোত্তম এবং এর মাধ্যমে কোম্পানি, পণ্য বা সেবা সম্পর্কে গ্রাহকদের মনে একটি ভালো ইমেজ তৈরি করে। ফলে ভোক্তারা ব্র্যান্ড পরিবর্তন করতে, একটি নতুন পণ্য ব্যবহারের চেষ্টা করতে বা বর্তমান ব্র্যান্ডের প্রতি অনুগত থাকতে প্রভাবিত হয়।
৩. মনে করিয়ে দেওয়া (To remind):
বিজ্ঞাপনের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো পণ্য বা ব্র্যান্ডের বার্তাকে শক্তিশালী করা এবং ব্র্যান্ডের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বর্তমান এবং সম্ভাব্য গ্রাহকদের আশ্বস্ত করা। অনুস্বারক বিজ্ঞাপন ভোক্তাদের একটি পণ্য বা সেবার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মনে করিয়ে দেয় এবং অবিলম্বে কেন পণ্য বা সেবাটি কেনা উচিৎ সে সম্পর্কে বারবার বলতে থাকে ।
উপরের ৩টি মূল উদ্দেশ্যের পাশাপাশি বিজ্ঞাপনের আরও কিছু উদ্দেশ্য আছে যেগুলো মূলতঃ এই ৩ টি উদ্দেশ্য থেকেই উদ্ভূত। বিজ্ঞাপনের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উদ্দেশ্য গুলো হলো:
১) নতুন পণ্য পরিচয় করিয়ে দেওয়া (Introduce a product):
বিজ্ঞাপনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যই হলো বাজারে একটি নতুন পণ্য প্রবর্তন করা। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নতুন পণ্যের গুণাগুণ, মূল্য, ব্যবহারবিধি ইত্যাদি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য ক্রেতাদের অবহিত করা হয়। খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, বাজারে সবচেয়ে নতুন মডেলের আইফোন বা স্যামসাং, স্মার্টফোনের জন্য প্রচুর বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। এখানে বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য হল গ্রাহকদের বলা, “আমরা এই নতুন পণ্যটি আপনার জন্য চালু করেছি” ।
২) চাহিদা সৃষ্টি (Demand creation):
পণ্য সম্পর্কে ভোক্তাদের অবহিত করার উদ্দেশ্যই হলো এর চাহিদা তৈরি করা। বিজ্ঞাপনগুলো প্রায়শই পণ্যের গুণাবলীকে গ্রাহকের প্রয়োজনীয়তার সাথে মিলিয়ে আকর্ষণীয় ভাবে উপস্থাপন করে থাকে যাতে ভোক্তারা পণ্যটির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারে। এর মাধ্যমে বিজ্ঞাপন চাহিদা তৈরি, বিক্রয় বজায় রাখা বা বৃদ্ধি করার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে ।
৩) গ্রাহকদের সাথে যোগাযোগ করা (Communicate with the customers ):
বিজ্ঞাপনের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো পণ্যের মূল্যের পরিবর্তন, গুণমানের উন্নতি, নতুন পণ্য লাইন প্রবর্তন, বা নতুন কোন ব্যবহার সম্পর্কে বিশদ বিবরণ ইত্যাদি ভোক্তাদের সাথে যোগাযোগ করা। গ্রাহককে পণ্য বা ব্র্যান্ড সম্পর্কে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য নিয়মিত বিজ্ঞাপন প্রয়োজন । বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভোক্তাদের সাথে পণ্য বা ব্র্যান্ডের নিয়মিত যোগাযোগ ব্র্যান্ডের নামটি ভোক্তার মনে তাজা রাখতে সাহায্য করে থাকে।
৪) ব্র্যান্ড তৈরি (Brand building):
যখন কোন ব্র্যান্ড নিয়মিত বিজ্ঞাপন দেয়, মানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহ করে এবং আনুষাঙ্গিক প্রতিশ্রুতি পূরণ করে, তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই ব্র্যান্ডের মান তৈরি হয়। সাম্প্রতিক কালে ভারতে ম্যাগি নুডলসে উচ্চ সীসা সামগ্রীর উপস্থিতির কারণে সেখানে ম্যাগি নুডলসের বিক্রয় ও ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু ম্যাগির উপরের এই নিষেধাজ্ঞা এটির মূল ব্র্যান্ড নেসলেকে খুব বেশি প্রভাবিত করেনি এবং নেসক্যাফের মতো এর অন্যান্য ব্র্যান্ডগুলোকেও প্রভাবিত করেনি যারা তাদের নিজস্ব একটি ব্র্যান্ড পরিচিতি তৈরি করেছিল এবং মূল ব্র্যান্ড থেকে স্বাধীন ছিল। নেসলে বা নেসক্যাফে নিজেদের ভালো ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিতি, ভালো পণ্য ও ব্র্যান্ড ইক্যুইটি তৈরি এবং দর্শকদের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য ক্রমাগত বিজ্ঞাপন ব্যবহার করেছিল।
৫) প্রতিযোগিতার মোকাবেলা করা (To face the competition):
আধুনিক দিনে বিজ্ঞাপন শুধুমাত্র একটি পণ্য সম্পর্কে ভোক্তাদের জানানোর জন্য নয়, বরং বাজারের প্রতিদ্বন্দ্বী পণ্যগুলো থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দিয়ে নিজের পণ্যের দিকে টেনে নিয়ে আসা, পণ্যটির চাহিদা বজায় রাখা এবং বৃদ্ধি করার জন্যও ব্যবহার করা হয়। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থাতেও বিজ্ঞাপন ব্র্যান্ড ইমেজ এবং ব্র্যান্ড আনুগত্য গড়ে তুলতে সাহায্য করে । আর এই অনুগত বা বিশ্বস্ত গ্রাহকরাই হচ্ছে প্রতিযোগিতার সময়ে টিকে থাকার জন্য কোম্পানির সবচেয়ে ভালো সুরক্ষা ব্যবস্থা।
৬) বাজার প্রসারিত করে (Expands market):
বিজ্ঞাপন বাজারে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করে ব্যবসার জন্য বাজারের সুযোগকে প্রসারিত করে। এর মাধ্যমে কোম্পানির পণ্য বা সেবাগুলো সম্পর্কে বিপুল সংখ্যক লোক জানতে পারে এবং পণ্যের নতুন বাজার তৈরির মাধ্যমে বাজার সম্প্রসারণ ঘটে। যেমন- এনার্জি ড্রিংকের বিজ্ঞাপনের বহুল প্রচারের মাধ্যমে শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও এর বাজার বিস্তৃতি ঘটেছে।
৭) ব্র্যান্ড ইমেজ বা ভাবমূর্তি তৈরি করা (Building brand image):
ব্র্যান্ডের একটি ভালো ইমেজ এবং খ্যাতি তৈরিতে বিজ্ঞাপনের একটি কার্যকর ভূমিকা রয়েছে। বিজ্ঞাপন কোম্পানি এবং এর পণ্যগুলোকে গ্রাহকদের কাছে আরও ভালো উপায়ে পরিচয় করিয়ে দেয়। এটি পণ্যের গুণমান ব্যাখ্যা করে এবং ভোক্তা সাধারণের মনে একটি ভালো ইমেজ বা ভাবমূর্তি তৈরি করে । ফলে কোম্পানি ও পণ্যের প্রতি ভোক্তাদের আস্থা তৈরি হয়।
৮) সুনাম সৃষ্টি (Creation of goodwill):
বিজ্ঞাপন শুধুমাত্র কোম্পানির পণ্যকে উপস্থাপনের কাজই করে না, পাশাপাশি কোম্পানির সুনাম তৈরির প্রচেষ্টাও চালায়। যেমন- পরিবেশ দিবস, ধরিত্রি দিবস, বা এদেশের স্বাধীনতা দিবসের মতো বিশেষ বিশেষ দিনে কোম্পানি শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে বা সচেতনতা তৈরির জন্য বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। এটি বাজারে কোম্পানির পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায়, বাজার অবস্থানকে শক্তিশালী করে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সুনাম সৃষ্টি করে।
৯) খরচ কমায় (Reduce cost):
বিজ্ঞাপন বৃহদায়তন উৎপাদনের সুযোগকে প্রসারিত করে পণ্যের খরচ কমায়। বিজ্ঞাপনের ফলে পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায়, যার কারণে ব্যবসার উৎপাদন স্তর বৃদ্ধি পায় এবং পণ্যের প্রতি-ইউনিট উৎপাদন খরচ হ্রাস পায় ।
১০) বিক্রয় এবং মুনাফা বৃদ্ধি (Increases sales and profit):
বিজ্ঞাপনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়ের পরিমাণ এবং লাভের পরিমাণ বাড়ানো। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোম্পানি পণ্যের দিকে ভোক্তাদের পাশাপাশি খুচরা কারবারি, পাইকার বা অন্যান্য মধ্যস্থতাকারীদের আকৃষ্ট করে এবং তাদের পণ্য কিনতে প্ররোচিত করে। ফলে বিক্রয় বৃদ্ধি ও খরচ কমার দরুণ কোম্পানির মুনাফাও বৃদ্ধি পায় ।
পরিশেষে বলা যায়, বিজ্ঞাপন একটি কোম্পানিকে বাজারে তার শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সাহায্য করে। এভাবে বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য অর্জনের মাধ্যমেই প্রাতিষ্ঠানিক সফলতা অর্জন নিশ্চিত হয়।
বিজ্ঞাপনের গুরুত্ব (Importance of Advertising):
বিজ্ঞাপন হলো কোম্পানির পণ্য সম্পর্কে গ্রাহকদের জানাতে এবং কোম্পানি ও পণ্যের প্রতি গ্রাহকদের বিশ্বাস তৈরি করতে ব্যবহৃত সবচেয়ে কার্যকর প্রসার হাতিয়ার। প্রতিটি কোম্পানি তাদের পণ্য বা সেবার প্রচারে সহায়তা করার জন্য কোন না কোন ধরণের বিজ্ঞাপন ব্যবহার করে থাকে। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ক্রেতারা তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য বা সেবাটি কোথা থেকে কী দামে কখন কীভাবে কোন স্থান থেকে কিনতে পারা যাবে সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পায় এবং পণ্য বা সেবা কিনে তাদের প্রয়োজন মেটাতে পারে। বিজ্ঞাপনের গুরুত্ব তাই অর্থনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। নিম্নের চিত্রের সাহায্যে বিজ্ঞাপনের গুরুত্বকে উপস্থাপন করা যায়:
১। বিজ্ঞাপনের অর্থনৈতিক গুরুত্ব (Economic importance of advertising) :
পণ্য ও সেবার বিক্রয় বৃদ্ধির মাধ্যমে কোম্পানির আর্থিক লক্ষ্য অর্জনে বিজ্ঞাপন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বিজ্ঞাপনের অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা হলো :
১) চাহিদা তৈরি করা (Creates demand):
বিজ্ঞাপন ক্রমবর্ধমান চাহিদার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। এটি বেশি সংখ্যক গ্রাহকদের পণ্য সম্পর্কে অবহিত করে এবং তাদেরকে পণ্যের বৈশিষ্ট্য ও সুবিধাগুলো ব্যাখ্যা করে পণ্য ক্রয় করতে প্ররোচিত করে। ফলে উক্ত পণ্য বা সেবার জন্য ভোক্তাদের ভেতর চাহিদা সৃষ্টি হয়।
২) নতুন পণ্য প্রবর্তন করা (To introduce new product) :
বর্তমান বা নতুন কোন বাজারে একটি নতুন পণ্য প্রবর্তন করা সহজ কোন কাজ নয়। কোম্পানি বা উৎপাদকের জন্য নতুন কোন গ্রাহক গোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করা এবং বিদ্যমান গ্রাহকদের ধরে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞাপন একটি নতুন পণ্য, ধারণা, ব্র্যান্ড, গুণমান, উপযোগিতা ইত্যাদি বহু সংখ্যক গ্রাহকের সামনে উপস্থাপনের মাধ্যমে তাদের প্রচলনের পথকে সহজতর করে তোলে।
৩) বিক্রয় এবং মুনাফা বাড়ানো (To increase sales and profit):
বিজ্ঞাপন পণ্য বিক্রয়ের পরিমাণ সর্বাধিক করার কার্যকর একটি উপকরণ। এটি কোম্পানির পণ্যগুলোতে আরও বেশি সংখ্যক লোককে আকৃষ্ট করে এবং তাদেরকে পণ্য কিনতে প্ররোচিত করে। যখন পণ্যগুলো নতুন বাজার এবং গ্রাহকদের মধ্যে প্রবেশ করে এবং পণ্যের চাহিদা বজায় থাকে ও পুনঃক্রয় অব্যাহত থাকে, তখন স্বাভাবিকভাবেই বিক্রয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। বিক্রয়ের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত মুনাফা আসে।
৪) প্রতিযোগিতার মোকাবেলা করা (To face competition):
বিপণনকারীরা প্রতি মুহুর্তেই প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হন। প্রতিষ্ঠিত পুরনো পণ্যটিও একটি নতুন পণ্য দ্বারা কঠোর প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে পারে। মানসম্পন্ন এবং পরিমিত বিজ্ঞাপন বিশ্বস্ত গ্রাহকদের ধরে রাখতে এবং পণ্যটিকে বাজারে যেকোন চ্যালেঞ্জিং প্রতিযোগিতার মোকাবেলা করতে ও দীর্ঘ সময়ের জন্য টিকে থাকতে সাহায্য করে। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন গুলো শুধুমাত্র প্রতিযোগিদের প্রতিহত করার জন্য চালু করা হয়।
৫) সুনাম সৃষ্টি (To create goodwill):
বাজারে ব্যবসার সুনাম বাড়াতে বিজ্ঞাপনের কার্যকর ভূমিকা রয়েছে। কোম্পানির মানসম্পন্ন পণ্যের বারবার বিজ্ঞাপন বাজারে কোম্পানির উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। এটি গ্রাহকদের মনে কোম্পানি ও ব্র্যান্ডের একটি ভালো ইমেজ তৈরি করে।
৬) সরাসরি বিক্রয়কে সহজতর করে (Facilitates direct selling):
বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মেইল অর্ডার ব্যবসাকে কাজে লাগিয়ে সরাসরি ভোক্তাদের কাছে পণ্য বিক্রয় সম্ভব হয়। ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভোক্তারাও কেবল শহরে পাওয়া যায় এমন পণ্য বা বিলাসদ্রব্য উপভোগ করতে পারেন। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পণ্য কোথা থেকে কীভাবে কী দামে পাওয়া যাবে তা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জেনে ক্রেতা সরাসরি উৎপাদকের কাছে থেকে পণ্য ক্রয় করতে পারেন ।
৭) দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব (Long lasting impact) :
বিজ্ঞাপন হলো যোগাযোগের একটি অডিও-ভিজ্যুয়াল পদ্ধতি এবং তাই গ্রাহকের উপর এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং লোকেরা বিজ্ঞাপিত পণ্যটিকে দীর্ঘ সময়ের জন্য মনে রাখে । এটি পণ্যটির জনপ্রিয়তা এবং পরিচিতি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। বিজ্ঞাপন উৎপাদকের দীর্ঘস্থায়ী ভাবমূর্তি তৈরিতেও সহায়তা করে।
৮) বৃহদায়তন উৎপাদনের সুবিধা তৈরি (Enjoy economics of scale):
যেহেতু বিজ্ঞাপন সারা বছর ধরে টেকসই চাহিদা তৈরি করতে এবং বজায় রাখতে সহায়তা করে, তাই বর্ধিত চাহিদা মেটাতে বৃহৎ আকারে উৎপাদনের প্রয়োজন হয়। বৃহৎ পরিসরে উৎপাদনের ফলে উৎপাদন খরচ কমে যায় এবং এর ফলে আয় বৃদ্ধি পায়। কেননা নির্দিষ্ট কিছু খরচ আছে যা উৎপাদনের সব স্তরেই তৈরি হয়। উৎপাদন স্বল্প পরিসরে হলে নির্দিষ্ট খরচের বোঝা বেশি হয় এবং মুনাফা কমে যায়। পক্ষান্তরে বৃহৎ আকারের উৎপাদন ইউনিট প্রতি গড় ব্যয় হ্রাস করে থাকে।
৯) কর্পোরেট ইমেজ তৈরি (Creation of corporate image):
বিজ্ঞাপন ক্রেতাদের কাছে শুধুমাত্র একটি পণ্যের বার্তা বহন করে না বরং একটি কোম্পানির ইতিহাস এবং সংস্কৃতিও বহন করে। এটি একটি কোম্পানিকে ভালো ভাবমূর্তি এবং খ্যাতি তৈরি করতে এবং বাজারে প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে। বেশিরভাগ গ্রাহক দোকানে গিয়ে মেরিল, হুইল, লাইফবয়, সানসিল্ক ইত্যাদির নাম পুনরাবৃত্তি করতে পারেন। কারণ তারা তাদের কর্পোরেট ইমেজ বা ভালো একটি ভাবমূর্তি তৈরি করেছে এবং গ্রাহকের কাছে তার পরিবারেরই একটি নাম হয়ে গেছে।
১০) সাশ্রয়ী (Cost effective):
বিজ্ঞাপন একটি পণ্যের প্রচারের জন্য খুবই সাশ্রয়ী একটি হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়। বিজ্ঞাপনের বিস্তৃত পরিধি, একই সাথে বিপুল সংখ্যক অভীষ্ট গ্রাহকের কাছে পৌছানোর ক্ষমতা এবং গ্রাহকদের মনে এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ইত্যাদি প্রসারের এই পদ্ধতিটিকে ব্যক্তিগত বিক্রয়ের মতো অন্যান্য প্রসারমূলক কৌশলগুলোর তুলনায় আরও সাশ্রয়ী করে তুলেছে।
২। বিজ্ঞাপনের সামাজিক গুরুত্ব (Social importance of advertising) :
বিজ্ঞাপন শুধুমাত্র একটি কোম্পানির অর্থনৈতিক অবস্থারই উন্নয়ন ঘটায় না, বরং একটি দেশের সামাজিক উন্নয়নেও এর ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। বিজ্ঞাপনের সামাজিক গুরুত্বসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১) যোগাযোগ/ অবহিত করা (To communicate/inform):
একটি বিজ্ঞাপনের প্রধান কাজই হলো কোম্পানির পণ্য বা সেবা সম্পর্কিত বার্তা গ্রাহকদের কাছে পৌছানো। উৎপাদক সম্ভাব্য গ্রাহকদের কাছে তার পণ্যের বৈশিষ্ট্য, গুণমান, মূল্য, ব্যবহারবিধি, মৌসুমীতা, শ্রেষ্ঠত্ব, উপযোগিতা ইত্যাদি সম্পর্কে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পরিষ্কার বার্তা প্রদান করে থাকেন। বিজ্ঞাপন এমন ভাবে বার্তাটি উপস্থাপন করে যাতে করে এটি গ্রাহকদের মনে উদ্ভূত সন্দেহের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে।
২) গ্রাহকদের শিক্ষিত করে (Educates the customers ):
বিজ্ঞাপনগুলো গ্রাহকদের বাজারে বিদ্যমান বিভিন্ন পণ্য সম্পর্কে অবহিত করে এবং একটি উপযুক্ত পণ্যে তাদের কী সন্ধান করা উচিত সে সম্পর্কে তাদের শিক্ষামূলক বার্তা দেয়। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোম্পানি পণ্যের ব্যবহার ভোক্তাদের সামনে এমনভাবে উপস্থাপন করে, যাতে ভোক্তারা সহজেই একটি পণ্যের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে জানতে পারে। পাশাপাশি বিজ্ঞাপন নানারকম স্বাস্থ্য বা শিক্ষামূলক বার্তাও দেয়, যা গ্রাহক সচেতনতা বাড়ায় ।
৩) জনকল্যাণ নিশ্চিতকরণ (Ensures public welfare ):
জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করা বিজ্ঞাপনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্দেশ্য। জনসাধারণের প্রত্যাশা এবং চাহিদা পূরণ না হলে, বিজ্ঞাপনটি জনসাধারণের সাথে একটি প্রতারণা হিসেবে বিবেচিত হবে। সব বিজ্ঞাপনেই তাই নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ওপর জোর দেওয়া হয়। অনেক কোম্পানিই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জনসাধারণকে কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখতে হয়, শক্তি বা জ্বালানী সংরক্ষণ করতে হয়, পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখতে হয় ইত্যাদি বিষয়ে জানিয়ে জনকল্যাণে ভূমিকা রাখে ।
৪) বিক্রয় কর্মীদেরকে সহায়তা করা (To support salesman):
বিজ্ঞাপন বিক্রয় বাড়ানোর জন্য বিক্রয়কর্মীদের প্রচেষ্টাকে সহায়তা করে। সঠিকভাবে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে এমন একটি পণ্য খুব সহজেই বাজারে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। বিক্রয়ের প্রক্রিয়াটি বিজ্ঞাপন দিয়ে শুরু হয় এবং বিক্রয়কর্মী ভোক্তাদের একটি পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে এটি শেষ হয়। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে যদি পণ্য বা সেবা সম্পর্কিত একটি সচেতনতা তৈরি করা যায়, তবে পণ্যের প্রকৃত উপযোগিতা এবং অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যগুলো বিক্রয় কর্মীরা সহজেই ক্রেতাদের বিশ্বাস করাতে পারেন।
৫) ব্যবসায়ীদের সহায়তা করা (To support dealers):
কখনও কখনও বিজ্ঞাপনের লক্ষ্য ব্যাপারী এবং পরিবেশকদের সহায়তা প্রদান করাও হয়। সংবাদপত্রে অনেক বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় যাতে পণ্যের বিবরণ সহ ব্যাপারী ও পরিবেশকদের তালিকাও দেওয়া হয়। ফলে ভোক্তারা সহজেই কার কাছে পণ্য পাওয়া যাবে তা জেনে কাঙ্ক্ষিত পণ্য ক্রয় করতে পারেন।
৬) সম্পর্ক বজায় রাখা ( To maintain relationship ):
পণ্য ও গ্রাহকের মধ্যে সম্পর্ক এবং বোঝাপড়া তৈরিতে বিজ্ঞাপনের গুরুত্ব অপরিসীম। কোম্পানি এবং পণ্যের সাথে ভোক্তার একবার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেলে, এটি পণ্য এবং সেবাগুলোর উপর ভোক্তার আস্থা এবং নির্ভরযোগ্যতা তৈরি করে। এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক যা কখনও শেষ হয় না ।
৭) সচেতনতা তৈরি করা (To create awareness):
বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পণ্য সম্পর্কে উপযুক্ত তথ্য প্রদান করে নতুন পণ্য, বিক্রয়কর্মী বা প্রচার কৌশলগুলোর জন্য পথ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। পণ্যের প্রাপ্যতা, মূল্যের হ্রাস- বৃদ্ধি, বিশেষ প্রচার, অফার, পরিবর্তিত সংস্করণ বা বিকল্প পণ্যের সম্ভাব্য ক্ষতিকর দিক ইত্যাদি সম্পর্কে জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। পণ্য সম্পর্কে কোনটি সত্য এবং কোনটি মিথ্যা ব্যবহারকারীদের তা জানা উচিত। পাশাপাশি কোন পণ্যটি ভোক্তাদের জন্য উপকারী আর কোনটি ক্ষতিকর, তাও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়। ফলে মানসম্মত পণ্য ব্যবহারে ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি পায় ।
৮) কর্মসংস্থান তৈরি করে (Generates employment):
বিজ্ঞাপন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জনসাধারণের জন্য লাভজনক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে। এটি যেমন সরাসরি চিত্রশিল্পী, অভিনয় শিল্পী, আলোকচিত্রী, টেকনিশিয়ান ইত্যাদির কর্মসংস্থান তৈরি করে, তেমনি পরোক্ষভাবে এটি কাগজ, রং, ইলেকট্রনিক ইত্যাদির মতো শিল্পের হাজারো কর্মীর কর্মসংস্থানের পথকে সুগম করে।
৯) জীবনযাত্রার মান উন্নীত করা (Uplift standard of living):
বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সাধারণ জনগণ এমন সব পণ্য সম্পর্কে জানতে এবং ব্যবহার করতে পারে, যেগুলো সম্পর্কে তাদের পরিষ্কার ধারণা ছিল না এবং সচরাচর সেসব পণ্যকে তারা বিলাসবহুল হিসেবে জানতো। বিজ্ঞাপন এর ফলে মানুষের ভোগ বাড়ে ও অল্প খরচে বেশি উৎপাদন সম্ভব হয় । যার ফলশ্রুতিতে সমাজের আয় বৃদ্ধি পায় এবং সমাজের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পায় ।
১০) সামাজিক সমস্যা সমাধান (Solves societal problems ):
প্রতিটি সমাজে মাদকাসক্তি, অশিক্ষা, কন্যা ভ্রূণ হত্যা, লিঙ্গ পক্ষপাত ইত্যাদির মতো নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সামাজিক সমস্যাগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করতে জনসচেতনতা বাড়ানো যায় । এভাবেই বিজ্ঞাপন কোম্পানির ও দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতিশীলতা আনার পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
বিজ্ঞাপন কি, বিজ্ঞাপনের বৈশিষ্ট্য, উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব বিষয়ক পাঠের সারসংক্ষেপ:
বিজ্ঞাপন হলো কোন পণ্য, সেবা বা ধারণার অর্থপ্রদত্ত প্রসার যা নির্দিষ্ট উদ্যোক্তা কর্তৃক অব্যক্তিক উপায়ে বর্তমান ও সম্ভাব্য ভোক্তাদের সাথে সেই পণ্য, সেবা বা ধারণার যোগাযোগ স্থাপন করে। বিজ্ঞাপনের বিস্তৃতি ব্যাপক এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রতিটি বিজ্ঞাপনেরই কোন না কোন অনন্য বিক্রয় প্রস্তাব থাকতে হয়। সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও, সাময়িকী, পোস্টার, হোর্ডিং, বিলবোর্ড বা ইন্টারনেটের মতো বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন দেওয়া যেতে পারে। বিজ্ঞাপনের মূল লক্ষ্যই হলো সম্ভাব্য ক্রেতাদের পণ্য সেবা সম্পর্কে অবহিত করা, ক্রয়ে প্ররোচিত করা এবং সময়ে সময়ে পণ্য বা সেবার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ক্রেতা মনে উপস্থিতিকে সতেজ রাখা।
পণ্য ও সেবার চাহিদা তৈরি, বিক্রয় বৃদ্ধি, প্রতিযোগিতার মোকাবেলা করা এবং খরচ কমানোর পাশাপাশি মুনাফা বৃদ্ধির মাধ্যমে কোম্পানির আর্থিক লক্ষ্য অর্জনে বিজ্ঞাপন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সেই সাথে গ্রাহকদের শিক্ষিত করা, সচেতনতা তৈরি করা, সামাজিক সমস্যা প্রতিরোধ, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং জনকল্যাণ নিশ্চিতকরণে সাহায্য করার মাধ্যমে বিজ্ঞাপন একটি দেশের সামাজিক উন্নয়নেও ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
আরও দেখুন……
1 thought on “বিজ্ঞাপন কি, বিজ্ঞাপনের বৈশিষ্ট্য, উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব”