বিজ্ঞাপন মাধ্যম, মাধ্যমের প্রকারভেদ এবং বিভিন্ন মাধ্যম নির্বাচনে বিবেচ্য বিষয় সমূহ

বিজ্ঞাপন মাধ্যম, মাধ্যমের প্রকারভেদ এবং বিভিন্ন মাধ্যম নির্বাচনে বিবেচ্য বিষয় সমূহ আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “বাউবি ও এসবিবিএ ৩৫০৫ বিপণন প্রসার” এর  “বিজ্ঞাপন-বিপণন প্রসারের মূল হাতিয়ার” ইউনিট ২ এর অন্তর্ভুক্ত।

মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ

Table of Contents

বিজ্ঞাপন মাধ্যম, মাধ্যমের প্রকারভেদ এবং বিভিন্ন মাধ্যম নির্বাচনে বিবেচ্য বিষয় সমূহ

 

উৎপাদনকারী এবং বিপণনকারীরা পণ্য ও সেবা সংক্রান্ত তথ্য ভোক্তা বা ক্রেতাদের কাছে পৌছে দেওয়ার জন্য বিজ্ঞাপনকে ব্যবহার করে থাকেন। পণ্য ও সেবা সংক্রান্ত এই তথ্য ভোক্তা বা ক্রেতাদের কাছে নানা উপায়ে পৌঁছে দেওয়া যায়। যে উপায় বা কৌশল অবলম্বন করে এই তথ্য প্রচার করা হয় তাকেই বিজ্ঞাপনের মাধ্যম বলে। এই মাধ্যম সমূহের ভিতরে রয়েছে টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, পোস্টার, বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড, পরিবহন, চলচ্চিত্র, ইন্টারনেট ইত্যাদি।

এই মাধ্যম সমূহের সঠিক ব্যবহারের উপর বিজ্ঞাপনের সফলতা বহুলাংশে নির্ভরশীল। তবে কোন মাধ্যমটি বিজ্ঞাপনদাতাকে কখন ব্যবহার করতে হবে, তা নির্ধারণ করা খুবই জটিল। বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য, পণ্য বা সেবার প্রকৃতি, বাজারের প্রকৃতি, বাজেট বরাদ্ধ, মাধ্যমের প্রকৃতি বা সরকারি নীতিমালা ইত্যাদি নানা বিষয়ের উপর নির্দিষ্ট বিজ্ঞাপন মাধ্যমের ব্যবহার নির্ভর করে।

 

মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ

 

বিজ্ঞাপন মাধ্যমের ধারণা

Concept of Advertising Media

 

যে পন্থা বা বাহনের সাহায্যে বর্তমান ও সম্ভাব্য ক্রেতাদের কাছে পণ্য ও সেবা সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন বার্তা পৌছে দেওয়া হয়, তাকে বিজ্ঞাপন মাধ্যম বলে। বিজ্ঞাপন মাধ্যমের সাহায্যে উৎপাদনকারী বা বিপণনকারীরা পণ্য ও সেবার বিজ্ঞাপন প্রচার করে থাকেন। বিজ্ঞাপনের বার্তাগুলো রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, ইন্টারনেট সহ বিভিন্ন মাধ্যমে ভোক্তারা দেখে বা শুনে থাকে। বিজ্ঞাপন মাধ্যম তাই কোম্পানি এবং ক্রেতাদের সাথে যোগসূত্র তৈরির কাজ করে থাকে। বিজ্ঞাপন মাধ্যমের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সংজ্ঞা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

Kotler and Armstrong-4, “Advertising media are the vehicles through which advertising massages are delivered to their intended audiences.” (অর্থাৎ, বিজ্ঞাপন মাধ্যম হলো সেসব বাহন যার সাহায্যে বিজ্ঞাপন বার্তাকে অভীষ্ট্য অডিয়্যান্সদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।)

Terence A. Shimp-4 “Advertising media are the general communication methods that carry advertising messages that is, television, magazines, newspapers, and so on.” (অর্থাৎ, বিজ্ঞাপন মাধ্যম হলো যোগাযোগের সাধারণ সেসব প্রণালী যা বিজ্ঞাপন বার্তাকে বহন করে থাকে, যেমন- টেলিভিশন, ম্যাগাজিন, সংবাদপত্র ইত্যাদি।)

Dirksen and Kroeger- “An advertising medium is the means or conveyance by which the sales message is carried to prospective customers.” (অর্থাৎ, বিজ্ঞাপন মাধ্যম হলো বিজ্ঞাপন বার্তাকে অভীষ্ট্য ক্রেতাদের কাছে পৌছে দেওয়ার উপায় বা বাহন।)

উপরের সংজ্ঞাগুলোকে বিশ্লেষণ করলে বিজ্ঞাপন মাধ্যমের যে ধারণা গুলো পাওয়া যায় তা হলো:

  • বিজ্ঞাপন মাধ্যম হলো বিজ্ঞাপন বার্তা ভোক্তাদের কাছে পৌছে দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত উপায় বা বাহন;
  • এটি কোম্পানির সাথে ভোক্তাদের মেলবন্ধন তৈরি করে;
  • এটি বিজ্ঞাপনকে দৃষ্টিগোচর করে তোলে;
  • বিজ্ঞাপনের সফলতা নির্ধারণে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে;
  • এবং টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, বিলবোর্ড, ইন্টারনেট ইত্যাদি বিজ্ঞাপনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে ।

 

উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বিজ্ঞাপন মাধ্যম হলো অভীষ্ট শ্রোতাদের কাছে বার্তা পৌঁছানোর জন্য ব্যবহৃত উপায় বা পন্থা। এর মাধ্যমে কোম্পানির পণ্য ও সেবা সংশ্লিষ্ট বার্তা ক্রেতা বা ভোক্তা সাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। বিজ্ঞাপনের সফলতা বহুলাংশেই বিজ্ঞাপন মাধ্যমের সঠিক বাছাই ও কার্যকর ব্যবহারের উপর নির্ভর করে। বিজ্ঞাপন মাধ্যমকে বুঝার সুবিধার জন্য নিম্নোক্ত চিত্রের সাহায্যে সহজভাবে উপস্থাপন করা যায়:

 

 

বিজ্ঞাপন মাধ্যমের প্রকারভেদ

Types of Advertising Media

নির্দিষ্ট ভোক্তাদের কাছে বিজ্ঞাপনের বার্তাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিজ্ঞাপনদাতা বিভিন্ন ধরণের মাধ্যম ব্যবহার করে থাকেন। কেবল একটি মাধ্যম ব্যবহার করে যেমন সকল ভোক্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় না, আবার একই পণ্যের জন্য সকল বিজ্ঞাপন মাধ্যমের যুগপৎ ব্যবহার সঠিক নাও হতে পারে। কেননা প্রতিটি বিজ্ঞাপন মাধ্যমেরই কিছু সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে। তাছাড়া ক্রেতা বা পণ্যের প্রকৃতি ভেদে বিজ্ঞাপন মাধ্যমের ব্যবহারেও ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিজ্ঞাপন মাধ্যমকে বিভিন্ন শ্রেনীতে ভাগ করা যায়:

 

 

Belch and Belch-এর মতে, বিজ্ঞাপন মাধ্যমকে মূলতঃ তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- সম্প্রচারিত মাধ্যম (টেলিভিশন ও রেডিও), মুদ্রিত মাধ্যম (সংবাদপত্র ও সাময়িকী বা ম্যাগাজিন), এবং সহায়ক মাধ্যম (আউট-অফ-হোম মাধ্যম-যার মধ্যে রয়েছে বহিঃবিজ্ঞাপন, ট্রানজিট বিজ্ঞাপন, স্ট্রিট ফার্নিচার বিজ্ঞাপন, বিলবোর্ড ইত্যাদি; বিশেষায়িত মাধ্যম- যার মধ্যে রয়েছে ইয়েলো পেজ বিজ্ঞাপন এবং প্রচারমূলক পণ্য বিপণন মাধ্যম যথা ব্যবসায়িক উপহার, স্মারক ইত্যাদি; এবং অন্যান্য বিজ্ঞাপন মাধ্যম- যার মধ্যে রয়েছে মুভি থিয়েটার বিজ্ঞাপন, ভিডিও গেম বিজ্ঞাপন, পার্কিং লট বিজ্ঞাপন, গ্যাস স্টেশন বিজ্ঞাপন ইত্যাদি)।

 

নিম্নে বিজ্ঞাপন মাধ্যম গুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো:

 

১। টেলিভিশন (Television):

বিজ্ঞাপন প্রচারের সর্বাপেক্ষা কার্যকর ও শক্তিশালী মাধ্যম হচ্ছে টেলিভিশন। উন্নত এবং উন্নয়নশীল সব দেশেই টেলিভিশন অসম্ভব জনপ্রিয় একটি বিজ্ঞাপন মাধ্যম। বিভিন্ন রং, ছবি, ভাষা, শব্দ, ছন্দ, দৃশ্য, গতি প্রভৃতির সমন্বয়ে টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের বার্তাকে জীবন্ত করে তোলে এবং বিজ্ঞাপনের আবেদনকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। টেলিভিশন সবচেয়ে ব্যাপক কাভারেজ বা বিস্তৃতি দিতে পারে। একটি বিজ্ঞাপন মুহুর্তের মধ্যে লাখো দর্শকের কাছে পৌছাতে পারে। এছাড়াও এটি দৃষ্টিশক্তি, শব্দ এবং গতিকে একত্রিত করে শ্রোতাদের ইন্দ্রিয়কে আকর্ষণ করতে পারে।

তাই টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের গতিশীলতা ও নাটকীয়তাকে কাজে লাগিয়ে সৃজনশীল বিজ্ঞাপন দিতে পারলে এটিই বিজ্ঞাপনের সব থেকে কার্যকর মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। পক্ষান্তরে, বিশৃঙ্খলতা টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের জন্য প্রাথমিক সমস্যা তৈরি করে। আবার টেলিভিশন এয়ারটাইম শুধু ব্যয়বহুলই নয়, সীমিত পিক টাইমের মধ্যে বিজ্ঞাপন সম্প্রচার করাটাও খুবই চ্যালঞ্জিং। এছাড়া, টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের স্থায়ীত্বকালও খুব কম হয়ে থাকে ।

 

২। রেডিও (Radio):

রেডিও বিজ্ঞাপনের একটি অন্যতম বড় মাধ্যম। বিশেষত উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোতে এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে বা তৃণমূলের শ্রোতাদের কাছে বিজ্ঞাপনের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার একটি কার্যকর মাধ্যম হতে পারে রেডিও। রেডিওর মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের বার্তাকে শ্রুতিমধুর শব্দবার্তা বা ছন্দে রুপান্তর করে শ্রোতাদের সামনে উপস্থাপন করা যায়। টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের ন্যায় রেডিও বিজ্ঞাপনেরও ব্যাপক বিস্তৃতি রয়েছে।

পাশাপাশি রেডিও বিজ্ঞাপনের খরচও তুলনামূলক কম এবং এখানে বিজ্ঞাপন বার্তা পুনঃপুনঃ প্রচার করার সুযোগ রয়েছে। নিরক্ষর মানুষদের কাছে বিজ্ঞাপন মাধ্যম হিসেবে রেডিওর ভালো গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তবে রেডিও বিজ্ঞাপনে শুধু অডিও মাধ্যম ব্যবহৃত হয় বলে অনেক ক্ষেত্রেই এটি শ্রোতার মনোযোগ পুরোপুরি আকর্ষণ করতে পারে না। এর স্থায়ীত্বকালও টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের মতোই কম। এছাড়া রেডিও বিজ্ঞাপনের আরেকটি বড় অসুবিধা হলো এই মাধ্যমে পণ্য বা সেবার কার্যকারিতা প্রদর্শন করা যায় না।

 

৩। সংবাদপত্র (Newspaper):

বর্তমান যুগে সংবাদপত্র বিজ্ঞাপনের খুবই প্রচলিত এবং জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। সংবাদপত্রকে সমাজের দর্পণ বলা হয়। শিক্ষার হার ও গণসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে সংবাদপত্রের পাঠকের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি বিজ্ঞাপনের মাধ্যম হিসেবেও এর ব্যবহার ও গুরুত্বও বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বল্পতম সময়ে নুন্যতম খরচে প্রায় সর্বস্তরের বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে সংবাদপত্রের সাহায্যে বিজ্ঞাপনের বার্তা পৌঁছানো যায়। সংবাদপত্র দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, পাক্ষিক, বা বিশেষ ধরণের হতে পারে।

বিজ্ঞাপনের মাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্রের বিস্তৃতি ব্যাপক, বিশ্বাসযোগ্যতা, নমনীয়তা ও আবেদনের স্থায়ীত্বকাল বেশি, এবং খরচ তুলনামূলক কম। তবে সংবাদপত্র বিজ্ঞাপনের সংক্ষিপ্ত জীবনকাল, নির্দিষ্ট পরিমান পাঠক, নাটকীয়তার অভাব, প্রদর্শনের অক্ষমতা ও গ্রামে-গঞ্জে ব্যবহারের সীমাবদ্ধতার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই বিজ্ঞাপনদাতারা সংবাদপত্রকে বিজ্ঞাপনের মাধ্যম হিসেবে নির্ধারণের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করে থাকেন ।

বিজ্ঞাপন মাধ্যম, মাধ্যমের প্রকারভেদ এবং বিভিন্ন মাধ্যম নির্বাচনে বিবেচ্য বিষয় সমূহ

৪। সাময়িকী (Magazine) :

ম্যাগাজিন বা সাময়িকী বিজ্ঞাপনের আরেকটি বিশেষায়িত কিন্তু জনপ্রিয় মাধ্যম। গোটা বিশ্বেই আজ যোগাযোগ ও বিনোদনের একটি প্রধান উৎস হচ্ছে নানা শ্রেণীর সাময়িকী। সাময়িকী গুলো বিশেষ শ্রেনীর গ্রাহকের আগ্রহ পূরণ করে এবং বইয়ের চেয়ে অনেক বেশি সাম্প্রতিক তথ্য দেয়। সাময়িকী গুলোর আকর্ষণীয় ছবি এবং গ্রাফিক্স এর ব্যবহারের জন্য বিজ্ঞাপন দাতারা তাদের পণ্যের সংবাদ উপস্থাপন, পণ্যকে প্রদর্শন এবং নানা ঢঙ্গে পণ্যের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়ার জন্য সাময়িকী বেছে নেন। পাঠকদের মাঝে ম্যাগাজিন সংরক্ষণের প্রবণতা আছে বলে এর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী পণ্য আবেদন তৈরি করা যায়।

এছাড়া ভোক্তা শ্রেণীভেদে সাময়িকী নির্বাচন করে তাদের রুচি ও পছন্দ অনুযায়ী বিজ্ঞাপন দেওয়া যায় বলে বিশেষ শ্রেণীর ভোক্তাদের কাছে এর কার্যকারিতা সবচেয়ে বেশি। যেমন- কসমেটিকসের বিজ্ঞাপন মহিলা বিষয়ক সাময়িকীতে দিলে সহজেই মহিলা ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সম্ভব হয়। সাময়িকী নানা ধরণের হতে পারে যেমন- সাধারণ ভোক্তা সাময়িকী, মহিলা সাময়িকী, কৃষি সাময়িকী, বৈজ্ঞানিক সাময়িকী, ব্যবসায়িক সাময়িকী, পেশাগত ও টেকনিক্যাল সাময়িকী ইত্যাদি।

 

৫। ট্রানজিট বা পরিবহণ (Transit Advertising):

বিজ্ঞাপনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো পরিবহন বা ট্রানজিট বিজ্ঞাপন। বিভিন্ন যানবাহন যেমন- বাস, ট্রেন, মোটরগাড়ি এবং অন্যান্য যানবাহনের ভিতরে বা বাইরে এবং পরিবহন টার্মিনালগুলোতে পণ্য বা সেবার বার্তা সম্বলিত যে বিজ্ঞাপনগুলো দেখা যায়, তাকেই পরিবহন বিজ্ঞাপন বলে। যেমন- বিআরটিসি বাসের বহির্ভাগে, ট্যাক্সিক্যাবের পিছনে, সিএনজির পিছনে গ্রামীনফোন, রবি, বাংলালিংক সহ নানা মোবাইল কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখা যায়। আবার বিভাগীয় শহর গুলোর ইজিবাইক বা অটোরিক্সা গুলোর পিছনে RFL কোম্পানির পিভিসি পাইপ, প্লাস্টিক আইটেম, খাদ্যসামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে গ্রাহকেরা এই ধরণের বিজ্ঞাপন দেখে থাকেন। তবে গ্রাম এলাকায় বা ছোট শহর গুলোতে এখনো পরিবহন বিজ্ঞাপন জনপ্রিয় হতে পারেনি।

 

৬। বহিঃবিজ্ঞাপন (Outdoor Advertising):

ঘরের বাইরে, দেশের প্রধান প্রধান সড়কের পাশে, বড় ভবনের ছাদে, ব্যস্ত নৌপথ বা রেলওয়ে স্টেশনের পাশে কিংবা শহরের ব্যস্ততম বাণিজ্যিক ও জনবহুল এলাকায় বিরাট আকৃতির সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড বা প্রচারপত্রের মাধ্যমে যে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করা হয় তাকে বহিঃবিজ্ঞাপন বলে । গ্রাহকদের চলাচলের পথে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা ও পণ্য বা সেবার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য এই ধরণের বিজ্ঞাপন মাধ্যম ব্যবহৃত হয়। এই মাধ্যমে উপস্থাপিত বিজ্ঞাপন দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই গ্রাহকদের দেখার জন্য উন্মুক্ত থাকে বলে এর স্থায়ীত্ব ও নমনীয়তাও বেশি হয়ে থাকে।

এছাড়া বিজ্ঞাপনকে নানা চটকদার সাজে সজ্জিত করে উপস্থাপন করা যায় বলে সহজেই ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। তবে এই ধরণের বিজ্ঞাপনে অনেক ক্ষেত্রেই বিজ্ঞাপনের মূল আবেদনকে পুরোপুরিভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় না এবং এর ব্যয় অনেক বেশি হয়ে থাকে। বহিঃবিজ্ঞাপনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পোস্টার, বিলবোর্ড, নিয়ন সাইন, ইলেকট্রিক সাইন, আকাশ বিজ্ঞাপন যেমন- উড্ডীয়মান বেলুনে বিজ্ঞাপন ইত্যাদি।

 

৭। ইন্টারনেট (Internet Advertising):

বিজ্ঞাপনের মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ও ওয়েবসাইটের ব্যবহার বর্তমান যুগে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রসারের ফলে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ট্যাবলেটের মতো ডিভাইসের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে ইন্টারনেট ভিত্তিক বিভিন্ন সাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ ঘরে বসেই এখন তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য বা সেবা সম্পর্কিত বিজ্ঞাপন দেখতে পাচ্ছে এবং ইন্টারনেটের সাহায্যে দরকারি তথ্য খুঁজে দেখে ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারছে।

যেমন- আধুনিক এই যুগে জুতো, জামা- কাপড়, ইলেকট্রনিক বিভিন্ন ডিভাইস, এপার্টমেন্ট ইত্যাদির বিজ্ঞাপন প্রদানের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি মাধ্যম হচ্ছে ইন্টারনেট ও ওয়েবসাইট ভিত্তিক নানা সাইট।

 

৮। সরাসরি ডাক বিজ্ঞাপন (Direct Mail Advertising) :

গ্রাহকদের কাছে বিজ্ঞাপনের বার্তা পৌঁছানোর প্রাচীন পদ্ধতিগুলোর একটি হলো সরাসরি ডাক বিজ্ঞাপন। এক্ষেত্রে ছাপানো বিজ্ঞাপনসমূহ বর্তমান ও সম্ভাব্য ক্রেতাদের কাছে সরাসরি ডাকযোগে তাদের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাই অনেক সময় একে শুধুমাত্র ডাক বিজ্ঞাপন হিসেবেও অভিহিত করা হয়। ছোট-বড় প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই নিয়মিত বিজ্ঞাপনের সহায়ক হিসেবে অনেক সময় সরাসরি ডাক বিজ্ঞাপন ব্যবহার করে থাকে।

সরাসরি ডাক বিজ্ঞাপনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পোস্টকার্ড, বুকলেট, ক্যাটালগ লিফলেট, বিক্রয়পত্র ইত্যাদির মাধ্যমে প্রদত্ত বিজ্ঞাপন। সরাসরি ডাক বিজ্ঞাপনের খরচ কম, নির্দিষ্ট গ্রাহক নির্বাচনযোগ্যতা দ্রুত সাড়া লাভের সম্ভাবনা এবং স্থায়ীত্বকাল বেশি। তবে এটি সময়সাপেক্ষ একটি প্রক্রিয়া, এর বিস্তৃতি খুবই কম এবং নির্দিষ্ট ক্রেতাদের তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন বলে এর ব্যবহারও অনেক ক্ষেত্রেই সীমিত।

 

৯। চলচ্চিত্র (Cinema):

চলচ্চিত্রও বিজ্ঞাপন প্রচারের একটি ভালো মাধ্যম হতে পারে। সিনেমা হল বা প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা শুরুর আগে বা মধ্য বিরতির সময় বিভিন্ন পণ্য বা সেবা সম্পর্কে যে বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয় তাকে চলচ্চিত্র বিজ্ঞাপন বলে । এক্ষেত্রে টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের মতোই রং, শব্দ, গতি, ছন্দ, গ্রাফিক্স ইত্যাদির ব্যবহারের মাধ্যমে বিজ্ঞাপনকে জীবন্ত ও আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করা যায়। চলচ্চিত্র বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে অনেক সময় স্থির বিজ্ঞাপন চিত্র উপস্থাপন করে নেপথ্যে কণ্ঠ দিয়ে বিজ্ঞাপনে নাটকীয়তা তৈরি করা হয়। দেশের প্রায় সব প্রেক্ষাগৃহেই চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ফাঁকে ফাঁকে বিজ্ঞাপন দেখানোর রেওয়াজ আছে।

 

১০। ডাইরেক্টরি (Directory):

বিভিন্ন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের নাম, ঠিকানা, বিক্রয়কেন্দ্র, টেলিফোন নম্বরসহ বিবিধ তথ্যাবলি সম্বলিত প্রকাশিত বইকেই ডাইরেক্টরি বলা হয়। তাই ডাইরেক্টরি বিজ্ঞাপন হলো এমন একটি বিজ্ঞাপন যা একটি নির্দিষ্ট ডাইরেক্টরিতে প্রদর্শিত হয়, যেমন- ইয়েলো পেজ (Yellow Pages)। ডাইরেক্টরি বিজ্ঞাপন একটি ব্যবসার অভীষ্ট শ্রোতাদের কাছে পৌছানোর জন্য নির্দিষ্ট এবং সংজ্ঞায়িত স্থানগুলোকে লক্ষ্য করে বেশি বার খোঁজা হয়েছে এমন ডাইরেক্টরি গুলোকে ব্যবহার করে। ফোন বুকের বিজ্ঞাপন ডাইরেক্টরি বিজ্ঞাপনের খুবই সাধারণ একটি উদাহরণ।

উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বিজ্ঞাপনের জগতে বিভিন্ন রকম পণ্য বা সেবার প্রচারের জন্য বিভিন্ন রকম মাধ্যম ব্যবহার করা হয়। প্রায় সব মাধ্যমের ব্যবহারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মধ্যে মিল থাকলেও তাদের ধরণ, প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও কাজের বিস্তৃতির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। বিজ্ঞাপন দাতাকে এসব বিষয়ের দিকে খেয়াল রেখেই উপযুক্ত বিজ্ঞাপন মাধ্যম নির্বাচন করতে হয়।

 

মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ

 

বিজ্ঞাপন মাধ্যম নির্ধারণে বিবেচ্য বিষয়সমূহ

Considerable Factors in Advertising Media Determination

বিজ্ঞাপন মাধ্যম বলতে যে মাধ্যমে বিজ্ঞাপনদাতা তার বার্তা দর্শকদের কাছে পৌছে দিতে পারেন সেটিকে বোঝায়। একটি ব্যবসায় এবং তার পণ্য ও সেবার প্রচারে প্রতিটি বিজ্ঞাপন মাধ্যমের একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু পৃথক ভূমিকা রয়েছে। বিজ্ঞাপন মাধ্যমগুলোর কোনটা খুবই আধুনিক, আবার কোনটা বা খুবই গতানুগতিক। তাই বিজ্ঞাপন মাধ্যমের দীর্ঘ তালিকা থেকে বিজ্ঞাপনের জন্য সঠিক মাধ্যম বাছাই করা খুবই জরুরী। সঠিক মাধ্যম নির্বাচন বিজ্ঞাপনদাতাকে তার কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনে সাহায্য করে। যদি বিজ্ঞাপনের জন্য সঠিক মাধ্যম নির্বাচন করা না হয় তবে বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য অর্জনের সম্ভাবনা হ্রাস পায় এবং অভীষ্ট বাজারে ভুল বার্তা পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

তাই বিজ্ঞাপন প্রচারের সাফল্যের জন্য সঠিক বিজ্ঞাপন মাধ্যম নির্বাচন অত্যাবশ্যক। কোন পণ্যের বিজ্ঞাপনের মাধ্যম কী হবে, তা বিভিন্ন উপাদানের উপর নির্ভর করে । নিম্নে বিজ্ঞাপনের মাধ্যম নির্ধারণে প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান সমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

 

১। পণ্য বা সেবার প্রকৃতি (The nature of product):

বিভিন্ন পণ্যের প্রকৃতি নিজেই বিজ্ঞাপন মাধ্যম নির্বাচনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। পণ্য সাধারণত দুই ধরণের হয়, যথা- ভোক্তা এবং শিল্প পণ্য। পণ্য বা সেবার প্রকৃতি কিভাবে বিজ্ঞাপন মাধ্যম নির্বাচনকে প্রভাবিত করে তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো :

  •  পণ্যটি যদি ভোক্তা পণ্য হয়, তাহলে সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদি হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর বিজ্ঞাপন মাধ্যম।
  • শিল্প পণ্যের প্রচারের জন্য সম্প্রচার মাধ্যমের চেয়ে মুদ্রণ মাধ্যম বেশি সুবিধাজনক। শিল্প পণ্যের জন্য পণ্য সংশ্লিষ্ট সাময়িকী, ট্রেড জার্নাল বা সরাসরি ডাক বিজ্ঞাপন কার্যকর মাধ্যম হতে পারে।
  • যে পণ্য সকলের প্রয়োজন তার জন্য মূদ্রণ, সম্প্রচার, টেলিকাস্ট এবং বহিঃবিজ্ঞাপন এর মতো গণমাধ্যম ব্যবহার করা যেতে পারে ।
  • যেসব পণ্যের বিজ্ঞাপনের জন্য প্রদর্শনের প্রয়োজন, তার জন্য টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্র বিজ্ঞাপন মাধ্যম হিসেবে উত্তম।
  • সিগারেট, মদ, বীয়ার এবং অ্যালকোহল জাতীয় পণ্যগুলো কখনই রেডিও, টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্র বিজ্ঞাপন মাধ্যমে দেওয়া হয় না।

 

২। বাজার বা ক্রেতার প্রকৃতি (Nature of potential market):

সম্ভাব্য বাজার বা ক্রেতার প্রকৃতিও বিজ্ঞাপন মাধ্যম নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। একেক প্রকৃতির বাজারের জন্য একেক ধরণের মাধ্যম সবচেয়ে উপযোগী হতে পারে। ভোক্তা গোষ্ঠীর জনমিতি যেমন বয়স, আয়ের স্তর, ধর্ম, সামাজিক অবস্থান, ব্যয়ের অভ্যাস, সাক্ষরতার হার ইত্যাদি বিজ্ঞাপন মাধ্যম নির্ধারণে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। যেমন-

  • টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপন তরুণদের জন্য উপযুক্ত হতে পারে;
  • পত্র-পত্রিকা এবং ম্যাগাজিন শিক্ষিত লোকদের জন্য উপযুক্ত হতে পারে;
  • রেডিও বিজ্ঞাপন গ্রামীণ মানুষের জন্য উপযুক্ত হতে পারে।

 

৩। বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য (Advertising objective):

বিভিন্ন কোম্পানি এবং বিজ্ঞাপন উদ্দেশ্য বিজ্ঞাপন মাধ্যম নির্বাচনকে প্রভাবিত করে। বিজ্ঞাপন প্রচারের পিছনে যে উদ্দেশ্য থাকে, বিজ্ঞাপন মাধ্যম নির্বাচনের ক্ষেত্রে তা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হয়। বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্যগুলো কেবল গ্রাহকদের পণ্য বা সেবা সম্পর্কে অবহিত করা, তাদের কেনার জন্য প্ররোচিত করা, তাদের পুণরায় স্মরণ করিয়ে দেওয়া সহ আরও অনেক কিছু হতে পারে। উদ্দেশ্যের উপর নির্ভর করে বিজ্ঞাপন মাধ্যমের পছন্দও তাই ভিন্ন হয়। যেমন-

 

  • যদি বিজ্ঞাপনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হয় মোটাদাগে দেশের সকল মানুষকে বার্তা দেওয়া বা রাজি করানো, তাহলে সংবাদপত্র, রেডিও, টিভির মতো গণ- বিজ্ঞাপন মাধ্যম কার্যকর হতে পারে;
  • যদি উদ্দেশ্য শুধুমাত্র স্থানীয় বাজার কভার করা হয়, তাহলে পোস্টার এবং সরাসরি ডাক বা মেইল যোগাযোগ বেশি কার্যকর হতে পারে;
  • যদি বিপণনকারীরা জনগণের কাছ থেকে অবিলম্বে প্রতিক্রিয়া চান, তাহলে সরাসরি এবং বিশেষ বিজ্ঞাপনগুলো সবচেয়ে উপযুক্ত হতে পারে;
  • যদি বিপণনকারীরা কোম্পানি বা পণ্যের ভালো ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে চান, তাহলে গণবিজ্ঞাপন মাধ্যম বিশেষ করে সংবাদপত্র এবং ম্যাগাজিন উপযুক্ত হতে পারে।

 

৪ । বাজেটের প্রাপ্যতা (Availability of budget):

যেহেতু বিজ্ঞাপন প্রসারের অর্থপ্রদত্ত একটি মাধ্যম, এটির জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বাজেট প্রয়োজন হয়। যদি কোম্পানির বিজ্ঞাপনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ বাজেট বরাদ্ধ দেওয়া থাকে, তবে কোম্পানি তার পণ্য এবং সেবার প্রচারের জন্য যেকোন মাধ্যম বা প্রয়োজনে একাধিক মাধ্যম বেছে নিতে পারে। কিন্তু যদি কোম্পানির বিজ্ঞাপনের জন্য তহবিল সীমিত হয়ে থাকে এবং কোম্পানি এই সীমিত বাজেটেই তার পণ্যের বিজ্ঞাপন চালিয়ে যেতে চায়, তাহলে কোম্পানির জন্য তুলনামূলক সস্তা বিজ্ঞাপন মাধ্যম যেমন সংবাদপত্র, প্রদর্শনী, সরাসরি যোগাযোগ, ডোর-টু-ডোর বিজ্ঞাপন ইত্যাদি ব্যবহার করা ভালো ।

 

৫। বণ্টন পদ্ধতির ব্যাপকতা ও ধরণ (Extent and types of distribution strategy):

বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের বিস্তৃতির সাথে কোম্পানিটি যে বিতরণ ব্যবস্থা তৈরি করেছে তা সরাসরি সম্পৃক্ত। ভোক্তারা সাধারণত যে আউটলেট গুলো থেকে পণ্য কিনে থাকেন, সেখানে যদি সেই পণ্য এবং তার বিজ্ঞাপন পাওয়া না যায় তবে এইভাবে কোন পণ্যের বিজ্ঞাপন করার কোন মানে নেই।

একইভাবে কোম্পানির বিতরণ বা বন্টন প্রণালী দেশব্যাপী বিস্তৃত না হলে কোম্পানি বিজ্ঞাপনের জন্য জাতীয় মাধ্যম ব্যবহার করে কোন লাভ হবে না। বিজ্ঞাপনদাতা সরাসরি গ্রাহকদের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে সরাসরি ডাক বা মেইল বিজ্ঞাপন উপযুক্ত হতে পারে। আবার যদি কোম্পানি বণ্টন ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরের ব্যবসায়ীদের অনুপ্রাণিত করতে এবং প্ররোচিত করতে চায় যেমন এজেন্ট, পাইকারী বিক্রেতা, খুচরা বিক্রেতা ইত্যাদি, তবে বিতরণ প্রণালীর মাধ্যমেই বিজ্ঞাপন দেওয়া উচিত।

৬। বিক্রয় বার্তার ধরণ (Type of selling message) :

একটি কোম্পানি অভীষ্ট বাজারে যে বার্তা দিতে চায়, প্রায়শই তার উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমও নির্বাচন করতে হয়। যেমন-

  • বিজ্ঞাপনদাতা যদি আকর্ষণীয় রং, শব্দ, ছবি বা গ্রাফিক্স সহ মৌখিক বা অমৌখিক বার্তা ভোক্তা সাধারণের সাথে যোগাযোগ করতে চান তবে তাকে অবশ্যই টেলিভিশন বা চলচ্চিত্র বিজ্ঞাপন ব্যবহার করতে হবে।
  • যদি বিজ্ঞাপনদাতা শুধুমাত্র মৌখিক বার্তা, শ্রুতিমধুর শব্দ বা ছন্দ দিয়ে ভোক্তাদের সাথে যোগাযোগ করতে চান, তাহলে রেডিও বিজ্ঞাপন উপযুক্ত হতে পারে।
  • বিজ্ঞাপনদাতা যদি অমৌখিক কিন্তু আকর্ষণীয় রঙের সংমিশ্রণ দিয়ে ভোক্তা সাধারণকে নিয়মিত আকৃষ্ট করতে চান, তাহলে ইলেকট্রনিক চিহ্নের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেওয়া উপযুক্ত হতে পারে।

 

৭। বাজারের বিস্তৃতি (Extent of Coverage):

বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিজ্ঞাপনদাতা কতটা দর্শক বা বিস্তৃত এলাকা কভার করতে চান, বিজ্ঞাপনের মাধ্যম নির্বাচন করার সময় বিজ্ঞাপনদাতার তা বিবেচনা করা উচিত। কেননা বাজারের বিস্তৃতি বিজ্ঞাপনের মাধ্যম নির্বাচনকে প্রভাবিত করে থাকে। যেমন-

  • বিজ্ঞাপনদাতা যদি আন্তর্জাতিক ভাবে বিস্তৃত বাজারে বিজ্ঞাপন দিতে চান, তবে তিনি স্যাটেলাইট টেলিভিশন, ইন্টারনেট বা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে কোন ধরণের বিজ্ঞাপন মাধ্যম বেছে নিতে পারেন ।
  • বিজ্ঞাপনদাতা যদি দেশের সমগ্র শ্রোতাদের কভার করতে চান, তাহলে তিনি রেডিও, টিভি বা জাতীয় সংবাদপত্র বেছে নিতে পারেন।
  • বিজ্ঞাপনদাতা যদি শুধুমাত্র স্থানীয় বাজার কভার করতে চান তবে তিনি পোস্টার, সরাসরি যোগাযোগ, স্থানীয় সংবাদপত্র বা ম্যাগাজিন বেছে নিতে পারেন।

 

৮। মাধ্যমের প্রাপ্যতা (Availability of media):

বিজ্ঞাপন মাধ্যম নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মাধ্যমের প্রাপ্যতা গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হিসেবে কাজ করে। কেননা সব বাজারে সমস্ত বিজ্ঞাপন মাধ্যম সহজলভ্য নাও হতে পারে। আবার অনেক সময় একজন বিজ্ঞাপনদাতার কাঙ্খিত মাধ্যম বাজারে নাও পাওয়া যেতে পারে, এমন পরিস্থিতিতে মার্কেটারকে বাজারে পাওয়া যায় এমন মাধ্যম ব্যবহার করতে হয় কারণ তার হাতে সেসময় অন্য কোন বিকল্প থাকে না।

কিন্তু বাজারে যদি বিভিন্ন ধরণের বিজ্ঞাপনী মাধ্যম এবং এজেন্সি থাকে, তাহলে বিজ্ঞাপনদাতা তার বাজেট এবং উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সবচেয়ে সেরা এবং সবচেয়ে উপযুক্ত মাধ্যম নির্বাচন করতে পারেন। যেমন অনেক বিজ্ঞাপনদাতাই জায়গার সংকুলান হয় না বলে এবং সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিতে চান না, আবার অনেকেই শিডিউল সংকটের কারণে টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দিতে চান না।

 

৯। প্রতিযোগীদের বিজ্ঞাপন (Competitive advertising):

একজন বিজ্ঞাপনদাতাকে সফল হতে হলে তাকে তার প্রতিযোগী বা প্রতিযোগিদের নির্বাচিত মাধ্যম এবং ব্যয়ের ধরণের দিকে গভীর মনোযোগ সহকারে খেয়াল রাখতে হয়। প্রতিযোগী যদি মাধ্যম হিসেবে টেলিভিশনকে বেছে নেন, তবে বিপণনকারীকেও টেলিভিশনকেই বেছে নেওয়া উচিৎ আবার, বাজারে প্রতিযোগিতার মাত্রাও উপযুক্ত বিজ্ঞাপন মাধ্যম নির্বাচনকে প্রভাবিত করে।

বাজারে উচ্চ প্রতিযোগিতা থাকলে, বিপণনকারীকে ব্যয়বহুল বিজ্ঞাপনের জন্য যেতে হয় কারণ অভীষ্ট বাজারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তাকে তার বিজ্ঞাপনে আরও আকর্ষণীয় উপাদান, আরও বৈশিষ্ট্য, সুবিধা ইত্যাদি যোগ করতে হবে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বা প্রতিযোগিদের চেয়ে এগিয়ে যেতে হলে বিজ্ঞাপনদাতাকে অনেক সময় ও অর্থ ব্যয় করতে হয়।

 

১০। সরকারি নীতিমালা ( Government regulations):

বিজ্ঞাপন মাধ্যম নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন প্রচারের ব্যাপারে সরকারি সিদ্ধান্তসমূহ মেনে চলতে হয়। কেননা সরকারি নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিজ্ঞাপন তৈরি ও প্রদর্শন করতে হয় এবং সে অনুযায়ী বিজ্ঞাপন মাধ্যম নির্বাচন করতে হয়। যেমন- বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে টেলিভিশনে সিগারেট বা মদের বিজ্ঞাপন দেওয়ার সুযোগ নেই।

 

বিজ্ঞাপন মাধ্যম নির্বাচনে তাই বিজ্ঞাপনদাতাকে সতর্কতার সাথে উপরিউক্ত বিষয় সমূহকে বিবেচনা করতে হয়। এছাড়াও দর্শক-শ্রোতাদের সামাজিক ও ধর্মীয় বিশ্বাস, মূল্যবোধ, বিজ্ঞাপনের আবেদন, প্রচারণার সময় ইত্যাদি বিষয়ের দিকে খেয়াল রেখে বিজ্ঞাপন মাধ্যম নির্বাচন করা উচিৎ।

 

বিজ্ঞাপন পাঠের সারসংক্ষেপঃ

বিজ্ঞাপন মাধ্যম হলো সম্ভাব্য শ্রোতাদের কাছে পণ্য, সেবা, সংস্থা বা ধারণার বিজ্ঞাপনের বার্তা বহন করার জন্য ব্যবহৃত উপায় বা পন্থা। এই মাধ্যমের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ডিজিটাল মিডিয়া, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, সরাসরি মেইল বিজ্ঞাপন, রেডিও, টেলিভিশন, আউটডোর বিজ্ঞাপন, পরিবহন বিজ্ঞাপন এবং অন্যান্য বিশেষ বিজ্ঞাপন। তবে সার্বজনীনভাবে “সেরা” বিজ্ঞাপনী মাধ্যম বলে কিছু নেই।

কোন মাধ্যমটি “সর্বোত্তম” তা সম্পূর্ণরূপে বিজ্ঞাপনদাতার উদ্দেশ্য, সৃজনশীল চাহিদা, পণ্য বা বাজারে প্রকৃতি, প্রতিযোগিতামূলক চ্যালেঞ্জ, বাজেটের প্রাপ্যতা এবং সরকারি বিভিন্ন সম্প্রচার | নীতিমালার উপর নির্ভর করে। বিজ্ঞাপনদাতাকে তাই সর্বোত্তম বিজ্ঞাপন মাধ্যম বা মাধ্যম সংমিশ্রণ শুধুমাত্র নির্দিষ্ট মাধ্যমের সুবিধা এবং সীমাবদ্ধতা গণনা করে নয় বরং বিজ্ঞাপিত ব্র্যান্ডের প্রয়োজনীতা এবং সম্পদের প্রাপ্তির একটি কৌশলী পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হয়।

 

আরও দেখুন……

1 thought on “বিজ্ঞাপন মাধ্যম, মাধ্যমের প্রকারভেদ এবং বিভিন্ন মাধ্যম নির্বাচনে বিবেচ্য বিষয় সমূহ”

Leave a Comment